স্বদেশ ডেস্ক:
সিন্ডিকেট জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণের নামে আড়াই হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে দেশত্যাগী পিকে (প্রশান্ত কুমার) হালদারের অপকর্ম তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ও বর্তমান কয়েকজন কর্মকর্তার নাম এসেছে। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল লিমিটেডের নামে এসব অর্থ আত্মসাতে সহায়তা করার অভিযোগে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের বিষয়ে তথ্য পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদকের প্রধান কার্যালয়ে গতকাল মঙ্গলবার সকাল ১০টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন সংস্থাটির উপপরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা মো. গুলশান আনোয়ার প্রধান। এর আগে দুদকে হাজির হয়ে বক্তব্য দিতে গত ২৪ মার্চ এ দুই ব্যাংকারকে নোটিশ দেওয়া হয়েছিল।
দুদকের অনুসন্ধান তথ্য বলছে, পিকে হালদার এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি থাকাকালে মো. রাশেদুল হককে ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের এমডি হিসেবে ২০১৫ সালের জুন মাসে যোগদান করেন। তিনি এমডি হলেও প্রতিষ্ঠান চালাতেন মূলত পিকে হালদারই। পিকে হালদারের নির্দেশে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে দুই হাজার ৫০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়ে আত্মসাৎ করা হয়। যেসব ঋণের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো মর্টগেজ ছিল না।
জানা গেছে, ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতে ২২টি ও ফাস ফাইন্যান্সের অর্থ আত্মসাতে ১২টি সর্বমোট ৩৪টি মামলা হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের মোট ১২ আসামিকে গ্রেপ্তার
করা হয়েছে। গ্রেপ্তার হওয়া ১০ আসামি আদালতে নিজের দোষ স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন। যেই ১০ আসামি আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন তাদের একজন হচ্ছেন ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি রাশেদুল হক। তিনি আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেছেন, অর্থ আত্মসাতে পিকে হালদারকে সহায়তা করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। সেই ১৬৪ ধারা জবানবন্দির সূত্র ধরেই তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।
দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ শেষে এসকে সুর চৌধুরী ও শাহ আলম সাংবাদিকদের এড়িয়ে যান। কোনো প্রশ্নেরই জবাব দেননি দুজনের কেউই। এর মধ্যে এসকে সুর চৌধুরী শুধু একটি কথাই বলেছেন- ‘আমার যা বলার তদন্তকারী কর্মকর্তাকেই বলেছি।’
এ বিষয়ে দুদক সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেন, ‘পিকে হালদারের অর্থ আত্মসাৎ সংক্রান্ত মামলায় ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাশেদুল হককে গত বছর রিমান্ডে নেয় দুদক। এর পর তিনি বিজ্ঞ আদালতে ১৬৪ ধারা জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে নিজের দোষ স্বীকার করে দুজনের নাম বলেছেন, যারা লিজিং লুটের নেপথ্যে ছিলেন। তাদের একজন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম ও অপরজন ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী।’ দুদক সচিব বলেন, ‘রাশেদুল হকের জবানবন্দিতে নাম আসায় দুদক ওই দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। তাদের বক্তব্য রেকর্ড করা হয়েছে। এর সঙ্গে তথ্য উপাত্ত মিলিয়ে দেখে আইনগতভাবে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তাদের অবৈধ সম্পদের অনুসন্ধান করবেন কি-না, জানতে চাইলে দুদক সচিব বলেন, ‘১৬৪ ধারায় দেওয়া জবানবন্দিতে যাদের নাম আসবে তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য তদন্তকারী কর্মকর্তা রেকর্ড করবেন।’
পিকে হালদার সংশ্লিষ্টদের বিষয়ে দুদক সচিব বলেন, ‘ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের অর্থ আত্মসাতে ২২টি ও ফাস ফাইন্যান্সের অর্থ আত্মসাতে ১২টি সর্বমোট ৩৪টি মামলা হয়েছে। বিভিন্ন পর্যায়ের মোট ১২ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ১০ আসামি নিজের দোষ স্বীকার করে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।’ সম্পদ ক্রোকের বিষয়ে মাহবুব হোসেন বলেন, ‘এক হাজার কোটি টাকা সমমূল্যের সম্পদ ফ্রিজ ও ক্রোক করা হয়েছে। ৬৪ ব্যক্তি যেন বিদেশ যেতে না পারেন ইমিগ্রেশনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৩৩ জনের অবৈধ সম্পদের নোটিশ জারি করে যাচাইবাছাই চলমান।’
লিজিং কোম্পানিগুলোর অনেক অনিয়মের খবর সংবাদে আসে, শোনা যায় প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে পিকে হালদার সংশ্লিষ্টরা। দুদক এসব বিষয়ে কিছু করবে কি-না, জানতে চাইলে দুদক সচিব বলেন, ‘আর্থিক প্রতিষ্ঠান হোক বা যে কোনো প্রতিষ্ঠানই হোক, আইন বহির্ভূত কোনো কিছু করলে দুদক ব্যবস্থা নেবে।’
আদালতে দেওয়া রাশেদুল হকের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির বিষয়ে দুদক সূত্রে জানা যায়, এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আলোচিত প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের নির্দেশেই প্রতিষ্ঠানটিতে ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স থেকে অর্থ লোপাটের তথ্য ধামাচাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক নির্বাহী পরিচালক ও সাবেক এক ডেপুটি গভর্নরকে মাসিক দুই লাখ টাকা করে মাসোহারা দিতেন। জবানবন্দিতে সবচেয়ে বেশি উঠে এসেছে সাবেক ডেপুটি গভর্নর সিতাংশু কুমার সুর (এসকে) চৌধুরীর নাম। বাংলাদেশ ব্যাংকের অডিট টিমকে ম্যানেজ করতে লাখ লাখ টাকা ঢেলেছেন পিকে হালদার।
জবানবন্দিতে রাশেদুল হক বলেছেন, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম চাপা দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন কর্মকর্তাদের পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে দিত রিলায়েন্স ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিং। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও বাজার বিভাগের তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক শাহ আলমকে প্রতি মাসে দেওয়া হতো দুই লাখ টাকা করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি ‘ম্যানেজ’ করতেন সাবেক ডেপুটি গভর্নর এসকে সুর চৌধুরী। এ কর্মকর্তাদের সহায়তায় কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন আলোচিত পিকে হালদার।
রাশেদুল হক জবানবন্দিতে এও বলেছেন, পিকে হালদারের অন্যতম ক্ষমতার উৎস ছিলেন এসকে সুর চৌধুরী। তার মাধ্যমেই পিকে হালদার বিভিন্ন অনিয়মকে ম্যানেজ করতেন। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শন বিভাগ থেকে ইন্টারন্যাশনাল লিজিং পরিদর্শন করার জন্য বছরে দুবার সহকারী পরিচালক থেকে যুগ্ম পরিচালক পদের দুজন কর্মকর্তা আসতেন। তখন তাদের অনিয়ম না ধরার জন্য প্রতিবার পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা করে ঘুষ দেওয়া হতো। এর ভিত্তিতে তারা ইতিবাচক প্রতিবেদন দিতেন। এসকে সুর ও শাহ আলমকে ম্যানেজ করতেন।
রাশেদুল হক জবানবন্দিতে আরও বলেছেন, পিকে হালদার নিজের ইচ্ছামতো গ্রাহকদের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে একদিনের মধ্যে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়াই ঋণ অনুমোদন ও বিতরণ করতেন। অনেক সময় গ্রাহক জানত না যে, তার নামে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এভাবে এখানে শত শত কোটি টাকা অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন।
রাশেদুল হক জবানবন্দিতে বলেছেন, পিকে হালদার মূলত এদের এনআইডি কার্ড দিয়ে ভুয়া কোম্পানি বানিয়ে তা দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লিজিং থেকে লুট করেন। বেশিরভাগ পার্টিই ছিল পিকে হালদারের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু ও বান্ধবী। তারা পিকে হালদারের কাছে ঋণের প্রস্তাব দিলে তা সোহাগ, রাফসানদের মাধ্যমে ওই প্রস্তাব রাশেদুল হকের কাছে পাঠানো হতো। রাশেদুল হক মার্ক করে তা রুনাই আহমেদকে দিলে কোনো যাচাই-বাছাই ছাড়া এবং কোনো মর্টগেজ না নিয়ে পিকে হালদারের নির্দেশমতো ঋণ প্রস্তাব তৈরি করে তাতে রুনাই, সোহাগ ও রাফসান স্বাক্ষর করতেন। এমডি হিসাবে রাশেদুল হক অনুমোদন দিতেন। প্রতিটি বোর্ড মিটিংয়ে পিকে হালদার উপস্থিত থাকতেন এবং ঋণ প্রস্তাব অনুমোদনে বাধ্য করতেন।
রাশেদুল হক জবানবন্দিতে বলেছেন, বোর্ড সদস্যরা সবাই ছিলেন পিকে হালদারের লোক। তাই তারা ভুয়া ও অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠান জেনেও ঋণ অনুমোদন করে দিতেন। মো. নওশের উল ইসলাম, মমতাজ বেগম, পাপিয়া ব্যানার্জি, বাসুদেব ব্যানার্জি ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের পরিচালক হওয়া সত্ত্বেও অনিয়ম করে বেআইনিভাবে তাদের ভুয়া প্রতিষ্ঠান এমএসটি মেরিন, এমএসটি ফার্মা, নিউট্রিক্যাল ও জিএন্ডজি এন্টারপ্রাইজের নামে ঋণ নিতেন। সেই অর্থ পিকে হালদারসহ তার ঘনিষ্ঠদের হিসাবে স্থানান্তর করতেন। পরে ওই অর্থ উত্তোলন করে পিকে হালদার ও তার কয়েক সহযোগী বিদেশে পাচার করেছেন।
দুদকের টেবিলে থাকা অভিযোগে বলা হয়, পিকে হালদার সিন্ডিকেট দেশের কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অস্তিত্বহীন কাগুজে প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ নিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে। বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহযোগিতার কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে পিকে হালদার সিন্ডিকেট এসব অর্থ আত্মসাৎ করে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ আত্মসাতে পিকে হালদারকে সহযোগিতা করার অভিযোগে বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডজনের বেশি কর্মকর্তা জড়িত। যাদের বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান চলছে। অভিযোগ অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গর্ভনর এসকে সুর ও সাবেক নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে গতকাল জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এর আগে আরও পাঁচজন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।